‘সে কহে বিস্তর মিছা, যে কহে বিস্তর’
১০ অক্টোবর, ২০১৮ ১৬:১৩:৩২
শিরোনামে উল্লিখিত বাক্যটি উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত মনীষীর বাণী। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, কোনো মানুষ যদি অতিকথনের বাতিকে আক্রান্ত হয়, তাহলে তার দ্বারা প্রচুর মিথ্যা বলা সম্ভব। কারণ, বলতে বলতে সে সত্য-মিথ্যা তালগোল পাকিয়ে ফেলে এবং নিজের বক্তব্যকে সত্য প্রমাণ করতে গিয়ে অধিক মিথ্যা মুখ দিয়ে নির্গত করে। সত্য-মিথ্যার এ দ্ব›দ্ব চিরকাল চলে আসছে, চলবে যতদিন এ পৃথিবী থাকবে। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হয় আর মিথ্যা পরাজিত হয়- এমন একটা কথা চালু আছে। তবে কখনো কখনো মিথ্যা সত্যের ওপর রাজত্ব করে এবং মিথ্যার দাপটে সত্য দীর্ঘদিন চাপা পড়ে থাকে। এক সময় হয়তো সত্য উদঘাটিত হয়, তবে ততক্ষণে যার যা ক্ষতি হবার হয়ে যায়।
বিস্তর মিছা বলার প্রসঙ্গটি এনেছি এজন্যে যে, অসত্য আর অন্যায় কাজ করতে করে মানুষ এক সময় খেই হারিয়ে ফেলে। তখন তার কাজকর্ম এমন লেজেগোবরে হয়ে যায় যে, সে না চাইলেও তার কথা বা কাজের কদর্য রূপটি কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ পেয়ে যায়।
দেশে এখন পাইকারি হারে মামলা দায়ের হচ্ছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার থানায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চলছে পুলিশের মামলা দায়ের উৎসব। এমন কোনো দিন নেই যেদিন দু’চার দশটি মামলা দায়ের ও গ্রেফতারের খবর পত্রিকায় আসছে না। এসব মামলায় দুই-আড়াই বছর আগে পরলোাকে চলে যাওয়া ব্যক্তিসহ প্রবাসে অবস্থানকারীরাও আসামী হচ্ছেন। এ সংক্রান্ত বহু খবর গত দু’তিন সপ্তাহে খবরের কাগজে স্থান পেয়েছে।
তবে, এসব গায়েবি মামলার আসামি করার ক্ষেত্রে নজিরবিহীন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে গাজীপুর জেলার পশ্চিম টঙ্গী থানা। সেখানে একটি গায়েবি মামলার আসামী করা হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগের টঙ্গী থানা কমিটির বর্তমান সভাপতি মেহেদী হাসান কাননকে। খবরে বলা হয়েছে, টঙ্গী পশ্চিম থানার এসআই নাজমুল হুদা কর্তৃক দায়েরকৃত ওই মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৬ অক্টোবর বিএনপি, ছাত্র দল ও জামায়াতের কর্মীরা কলেজ গেট এলাকায় খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রসহ ভাঙচুর করার জন্য জড়ো হয়। এ অভিযোগে ৫১ জনের নামোল্লেখ করে প্রায় ৬০জনকে আসমি করে মামলাটি দায়ের করা হয়। এ প্রসঙ্গে মেহেদী হাসান সাংবাদিকদের বলেছেন, আমি ছাত্র লীগ ও আমার পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের সঙ্গে নাশকতা পরিকল্পনা করে পুলিশের কাজে বাধা দিয়েছি, এমন আজগুবি কল্পকাহিনী কেউ বিশ্বাস করবে না। এমন মামলায় আসামি হিসেবে তার নামঅর্ন্তভ‚ক্ত করে পুলিশ কর্মকর্তা অজ্ঞতা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন বলেও মন্তব্য করেছেন ছাত্র লীগ নেতা মেহেদী। অবশ্য থানার ওসি বিষয়টি ভুল বশত হয়েছে এবং সংশোধন করে মামলা নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংবাদমাধ্যমকে।
প্রশ্ন উঠেছে একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা এমন একটি মারাত্মক ভুল করলেন কী করে? মামলায় আসামি অন্তর্ভূক্ত করার সময় কি তার হুশ ছিল না? এ ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, সারা দেশে এখন কী হচ্ছে! টঙ্গীর লোকজনও বলেছে পুলিশ বর্ণিত দিন ও সময়ে টঙ্গী কলেজ গেটে ওরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাহলে মামলা হলো কিসের ভিত্তিতে? এখানেই আসল রহস্য। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে পুলিশ এখন মামলা দায়ের নিয়ে প্রতিযোগিতায় আছে। কে কত মামলা দায়ের করতে পারে, বা কোন থানায় কতগুলি মামলা রুজু করা যায় তা নিয়ে কম্পিটিশন চলছে। আর এ ক্ষেত্রে একটি মামলায় কে কতজনকে আসামি করতে পারছে তাও বোধকরি প্রতিযোগিতার একটি অন্যতম বিষয়। যেজন্য মৃত, প্রবাসী, রাজনীতি বা সভা-সমাবেশ মিছিলের ধারে কাছে যারা কশ্চিনকালেও যায়নি, তারাও হয়ে যাচ্ছে আসামি। এ ক্ষেত্রে পুলিশ কোনো ধরনের বাছ-বিচার, যাচাই-বাছাইয়ের ধার ধারছে না। যার নাম পাচ্ছে তাকেই তালিকাভ‚ক্ত করে দিচ্ছে। আর এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই টঙ্গী থানা ছাত্র লীগ নেতা বিএনপি কর্মী হিসেবে মামলার আসামি হয়ে গিয়েছিল।
মেহেদী হাসান কাননের কপাল ভালো সে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একজন কর্মী। তাই পুলিশ মামলা সংশোধন করে তা থেকে তার নাম বাদ দিয়েছে। কিন্তু এটা যদি কোনো সাধারণ মানুষের বেলায় ঘটতো? তাহলে কী মামলা সংশোধন করা হতো? মোটেই নয়। বরং অপরাধ না করেও তাকে হাজত বাস করতে হতো। বলাই বাহুল্য যে, এমন ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। আর তার শিকার হচ্ছে নিরপরাধ নিরীহ মানুষেরা। লেখার শুরুতেই বিস্তর কথা বলার কুফল উল্লেখ করেছিলাম। তেমনি যদি কেউ অতিরিক্ত কিছু করতে যায়, তাহলে মনের অজান্তেই এমন কাজ করে ফেলে যে, ভেতরের আসল সত্যটা আপনা আপনি বেরিয়ে আসে। দেশজুড়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পাইকারি হারে যেসব মামলা প্রতিনিয়ত দায়ের করা হচ্ছে, সেসবের ভিত্তি কতটা নড়বড়ে তা টঙ্গীর ঘটনার পর বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।